একটি আর্দশ নাগরিক রাষ্ট্র গড়তে হলে প্রয়োজন আদর্শ মানুষের। আর আদর্শ মানুষ উপহার দিতে পারে একজন আদর্শ মা। আর একজন মা হতে হলে প্রয়োজন একটি আদর্শ শিক্ষাকেন্দ্র। আর নারীর জন্য আদর্শ শিক্ষাকেন্দ্র হলো একটি কওমী মহিলা মাদরাসা। একটি কওমী মহিলা মাদ্রাসা হলো সমাজের সু-নাগরিক নির্মাণের কারখানা। দীনের ভিত্তিকে আরও উঁচু করার মানসে ঈমান রক্ষার কেন্দ্র হিসেবে কওমী মহিলা মাদরাসার বিকল্প নাই। যেখানে থেকে হযরত আয়েশা রাযি.-এর আদর্শিক সবক নিয়ে আদর্শ নারীর কাফেলা দীনের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণের পথকে তরান্বিত করবে। ফিরিয়ে আনবে ভূবন জয়ী নারীদের সমৃদ্ধ ইতিহাস।
প্রবাদ আছে, তোমরা আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের একটি শিক্ষিত জাতি উপহার দেবো।
একসময় মেয়েরা ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার জন্য স্বীকৃত তেমন কোনো প্রতিষ্ঠান ছিলো না। নিজের ঘর কিংবা এলাকার মক্তবই ছিল তাদের প্রাথমিক ধর্মীয় শিক্ষার উপযুক্ত স্থান। সেইসময়কার মেয়েরা ধর্মীয় শিক্ষায় যতটা না অগ্রগামী ছিলো, তারচেয়ে বেশি পিছিয়ে ছিলো জাগতিক শিক্ষার্জন থেকে। জাগতিক শিক্ষার্জন অনেকে ঘৃণার চোখে দেখতো।
কারণ, তখনকার মুসলিম মেয়েরা অতবেশি শিক্ষিত না হলেও ধর্মভীরু ছিলো। ধর্ম সম্পর্কে মা-দাদী থেকে যতটুকু জেনেছে তা পরিপূর্ণভাবে আমল করেছে। তারা শিক্ষার্জনে স্কুল-কলেজে যাওয়াকে ভিন্নচোখে দেখতো। নিজের ঘরই ছিল তাদের জন্য নিরাপদ এবং উপযুক্ত স্থান। তাই তখন প্রয়োজন পড়েনি তাদের জন্য আলাদা শিক্ষাঙ্গনের। জাগতিক শিক্ষাকে তারা গুরুত্বই দিতো না।
তবে সময়ের বিবর্তনে বদলে গেছে দৃশ্যপট।
এখন আধুনিক যুগ। শিক্ষার বিকল্প নেই।
স্লোগান উঠেছে শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। সকলের জন্য শিক্ষা বাধ্যতামূলক। এখন মানুষ নানামুখী শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে। বসে নেই মেয়েরাও। পুরুষের সাথে পাল্লা দিয়ে তারাও এগিয়ে যাচ্ছে জ্ঞান অন্বেষণের অনন্য এক উচ্চতায়।
তবে সমস্যাটা হচ্ছে ধর্মীয় শিক্ষা নিয়ে। জাগতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে এখন গ্রাম পাড়ি দিয়ে শহরে যেতে হয় না। প্রায় প্রতিটি এলাকা, গ্রাম, মহল্লায় গড়ে উঠেছে জাগতিক শিক্ষার নানামুখী সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। তবে মুসলিম দেশ হিসেবে সেই অনুযায়ী প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না ধর্মীয় মহিলা শিক্ষালয়।
ফলে মুসলিম পরিবারের মেয়েদেরও বাধ্য হয়ে যেতে হচ্ছে জাগতিক শিক্ষাকেন্দ্রগুলোতে। যেখানে নেই প্রকৃত ধর্মীয় শিক্ষা। নেই জীবন-যৌবনের নিরাপত্তা।
যেখানে মেয়েরা পাচ্ছে না প্রকৃত নৈতিক দীনি শিক্ষা। আছে সর্বদা বিপদের আশঙ্কা।
সবকিছু বিবেচনা করে যুগের চাহিদা মিটাতে আজ থেকে বিশ-পঁচিশ বছর পূর্বে বিভিন্ন জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হয় কওমী মহিলা মাদ্রাসা।
মহিলা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার শুরুলগ্নে অনেক প্রসিদ্ধ আলেম মহিলা মাদ্রাসার বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। তাঁদের বিরোধিতার উল্লেখযোগ্য কিছু কারণও ছিল। কিন্তু ধীরে-ধীরে সেই বিরোধিতা কেটে মহিলা মাদ্রাসার দিকেই ঝুঁকে পড়ে আলেমসমাজ থেকে শুরু করে সাধারণ মুসলমানরাও। কারণ, তারা স্পষ্ট লক্ষ্য করছে যে স্কুল-কলেজ মহিলাদের জন্য কিছুতেই নিরাপদ নয়। বিশেষকরে তারা জাগতিক শিক্ষাকেন্দ্রে ধর্মীয় শিক্ষার যথেষ্ট অভাব লক্ষ্য করছে।
ফলে মহিলা মাদ্রাসার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা দিনদিন বেড়েই চলেছে। মেয়েদের দ্বীন শেখাতে মহিলা মাদ্রাসার অবদান আজ অনস্বীকার্য। প্রকৃত দ্বীন মুসলিম ঘরে-ঘরে পৌঁছে দিতে মহিলা মাদ্রাসা নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। ইসলাম বিদ্বেষী অপশক্তি ইসলামকে চিরতরে মুছে দিতে জাগতিক শিক্ষার মাধ্যমে যে পায়তারা চালাচ্ছে তা আজ অনেকটা বাধাগ্রস্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে মহিলা মাদ্রাসা সঠিকপথে এগিয়ে যাওয়ার কারণে।
মহিলা মাদ্রাসায় যেমন সঠিক দ্বীন শিক্ষা দেওয়া হয়, তেমন যুগের চাহিদা মিটাতে বাংলা, অঙ্ক, ইংরেজি, সমাজ, বিজ্ঞান, কম্পিউটার ইত্যাদি বিষয়েও গুরুত্ব সহকারে পাঠদান করা হয়। ক্বওমী মহিলা মাদ্রাসার ছাত্রীদের লেখাপড়ার মানও মাশা-আল্লাহ স্কুল-কলেজের চেয়ে অনেকটা এগিয়ে। তাদের পাশের হারও উল্লেখযোগ্য।
অনেকে বলেন, স্কুল-কলেজের ছাত্রীরা যেরকম মাঝেমধ্যে অপকর্মে লিপ্ত হয়, তদ্রূপ মহিলা মাদ্রাসার ছাত্রীরাও তো অপকর্মে লিপ্ত হয়। তাহলে স্কুল-কলেজ আর মহিলা মাদ্রাসার মধ্যে পার্থক্য কই?
তাদের উদ্দেশ্যে বলবো, দেখি আপনারা প্রমাণ দিন যে হারে স্কুল-কলেজের ছাত্রীরা অপকর্ম, অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত হয় তদনুযায়ী মহিলা মাদ্রাসার ছাত্রীদের অবস্থান কোন পর্যায়ে?
বেহায়াপনা আর বেলেল্লাপনায় লিপ্ত হওয়ার প্রথম উপকরণ হল নারী-পুরুষ সমানতালে শিক্ষাঙ্গনে যাওয়া। মহিলা মাদ্রাসার ছাত্রীরা স্কুল-কলেজের ছাত্রীদের মত বয়ফ্রেন্ড নিয়ে গলায় হাত দিয়ে পার্কে ঘুরে বেড়ায় না। কোচিংয়ের নামে ছেলে-মেয়ে এক জায়গায় অশ্লীল আড্ডা জমায় না।
বিচ্ছিন্ন দু’একটি ঘটনা সব জায়গায় ঘটে। তাই বলে ঢালাওভাবে মহিলা মাদ্রাসাকে অপকর্ম, অসামাজিক কার্যকলাপের স্থান বলা চলে না। এই মহিলা মাদ্রাসা জাতিকে দক্ষ, শিক্ষিতা, নীতিবান, আদর্শ মা উপহার দিচ্ছে। যা ইসলামের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য বড্ড প্রয়োজন।
লেখক, মুহাদ্দিস-মাদরাসায়ে হালিমাতুস সাদিয়া রাযি. ঢাকা।